আজ আমরা "মানুষ তার মস্তিষ্কের কত শতাংশ ব্যবহার করে" এই বিষয়ে জানবো।
অনেকেই মনে করেন মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র দশ শতাংশ ব্যবহার করে?
এটা একেবারেই ভিত্তিহীন
প্রতিকি ছবি |
তবে তা হবে কল্পকাহিনীর জগতে, বাস্তব জীবনে এইরকম হবার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। বিজ্ঞানীরা ধারাবাহিকভাবে বহুবার দেখিয়েছেন যে মানুষ প্রতিদিন তাদের পুরো মস্তিষ্কই ব্যবহার করে। তবে একসঙ্গে মস্তিষ্কের সমস্ত কাজ মানুষ নিশ্চয়ই করে না। এবং একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান কিন্ত এখনও মানুষের মস্তিষ্কের সমস্ত কার্যকলাপের পুরোপুরি ব্যাখ্যা দিতে পারে নি। যেমন ভুতে ধরা, বসীকরণ ইত্যাদি।
যাই হোক, এতো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, 10 শতাংশের এই কাহিনী সাংস্কৃতিক কল্পনায় অনেক রেফারেন্সকে অনুপ্রাণিত করেছে। যেমন "লিমিটলেস" এবং "লুসি" এর মতো চলচ্চিত্রগুলিতে দেখিয়েছে।
2013 সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় 65 শতাংশ আমেরিকান এই মিথকে বিশ্বাস করে এবং 1998 সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মনোবিজ্ঞানের এক তৃতীয়াংশ সমস্যার কারণ মস্তিষ্কের কাজের উপর ফোকাস করে সৃষ্টি হয়।
নিউরোসাইকোলজি কি বলছে ?
নিউরোসাইকোলজি জানায় যে কীভাবে মস্তিষ্ক মানুষের আচরণ, আবেগ এবং জ্ঞানকে প্রভাবিত করে। বছরের পর বছর ধরে, মস্তিষ্কের বিজ্ঞানীরা দেদেখছে যে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ কিছু নির্দিষ্ট ফাংশনের জন্য দায়ী , তা সে রং চেনা হোক কিংবা সমস্যা সমাধান হোক ।
10 শতাংশ মিথের বিপরীতে, বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশ আমাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য অবিচ্ছেদ্য অংশ। গবেষণা এখনও একটি মস্তিষ্কের এলাকা খুঁজে পায়নি যা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। এমনকি একক নিউরনের স্তরে কার্যকলাপ পরিমাপ করা পরিক্ষাগুলিতেও মস্তিষ্কের কোনো নিষ্ক্রিয় এলাকা খুজে পায়নি বিজ্ঞান ।
অনেক ব্রেইন ইমেজিং পরিক্ষা ও রিসার্চ মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরিমাপ করে যখন একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট কাজ করছেন তা দেখায় কিভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ একসাথে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যখন আপনার স্মার্টফোনে এই পাঠ্যটি পড়ছেন, তখন আপনার মস্তিষ্কের কিছু অংশ, যার মধ্যে দৃষ্টিশক্তি, পড়া বোঝা এবং আপনার ফোন ধরে রাখার জন্য দায়ী অংশগুলি আরও সক্রিয় থাকবে।
10 শতাংশের মিথ কাহিনীর আরও সরাসরি পাল্টা বলা যায় যে, মস্তিষ্কের ক্ষতির শিকার হয়েছেন মানে স্ট্রোক, মাথার আঘাত, বা কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ার মাধ্যমে যাদের মস্তিষ্কের কিছু অংশের ক্ষতি হয়েছে তাদের এই সমস্যার কোনো প্রভাব পরতো না কারন আমরা তো মাত্র 10 শতাংশই ব্যবহার করি, কিন্ত বাস্তবে কি তাই হয় ? যদি 10 শতাংশ মস্তিষ্কের ব্যবহার করার কাহিনী সত্য হয়, তাহলে সম্ভবত 90 শতাংশ মস্তিষ্কের ক্ষতি দৈনন্দিন কার্যকারিতাকে তেমনভাবে প্রভাবিত করবে না।
তাহলে গবেষণাগুলিতে কেনো মস্তিষ্কের একটি খুব ছোট অংশকেও ক্ষতি বিধ্বংসী পরিণতি নিয়ে আসে ?
বিবর্তনবাদ কি বলছে ?
10 শতাংশ মিথের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রমাণ বিবর্তনবাদ থেকে উঠে এসেছে।
প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্ক শরীরের ভরের মাত্র 2 শতাংশ, তবুও শরীরের মোট শক্তির 20 শতাংশেরও বেশি খরচ করে। তুলনায়, কিছু মাছ, সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী সহ অনেক মেরুদণ্ডী প্রজাতির প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্ক তাদের শরীরের শক্তির 2 থেকে 8 শতাংশ খরচ করে ।
মস্তিষ্ক লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা তৈরি হয়েছে , যা বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য অনুকূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিবর্তন করেছে।
এটা কি করে হয় যে শরীর তার শক্তির একটা বড় অংশ উৎসর্গ করে সেই মস্তিষ্কের উপর যে মাত্র 10 শতাংশ ব্যবহার করে?
তাই এটা পরিষ্কার যে পুরো মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বজায় রাখতে শরীর তার 20 শতাংশ শক্তি মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সক্রিয় রাখতে ব্যবহার করে।
মিথের উৎপত্তি কোথা থেকে ?
"মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র দশ শতাংশ ব্যবহার করে" - এই ধারণাটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা যার উৎপত্তি স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে, ধারণা করা হয় এটি বিভিন্ন উৎস থেকে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে।
যেমন :
- উনিশ শতকের স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণা: উনিশ শতকে, বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের কোষের কাজ সম্পর্কে খুব কম জানতেন। তখন মস্তিষ্কের অনেক অংশের কাজ মানুষের অজানা ছিল। এই অজানা অংশগুলোকে "অব্যবহৃত" বলে মনে করে নেয় সাধারণ মানুষ ।
- উইলিয়াম জেমসের লেখা: উনিশ শতকের একজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস "দ্য এনার্জিস অব ম্যান" (The Energies of Men) বইয়ে লিখেছিলেন যে, "আমরা আমাদের সম্ভাব্য মানসিক শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যবহার করি।" যদিও জেমস স্পষ্টভাবে মস্তিষ্কের ব্যবহারের শতাংশ উল্লেখ করেননি, তার এই ধারণাটি ভুল ধারণার বিকাশে কিছুটা হলেও অবদান রেখেছিল।
- কিছু বই ও সিনেমা : বিংশ শতাব্দীতে, কিছু বই এবং জনপ্রিয় কিছু সিনেমা "মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র দশ শতাংশ ব্যবহার করে" - এই ধারণাটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ: লুসি সিনেমা
ধারণাটির স্পষ্ট ভুল প্রমাণ
আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, মানুষ তার মস্তিষ্কের সকল অংশ ব্যবহার করে। PET স্ক্যান, MRI, এবং EEG-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন যে, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও মস্তিষ্কের সকল অংশ সক্রিয় থাকে। এমনকি, মস্তিষ্কের যেসব অংশের কাজ এখনো অজানা, সেগুলোও বিভিন্ন কাজের সাথে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা হয়।
তাই "মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র দশ শতাংশ ব্যবহার করে" - এই ধারণাটি একটি ভুল ধারণা যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই প্রমানিত ও আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সকল অংশ ব্যবহার করি।
ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের শেয়ার করুন ও আপনার মতামত কমেন্টে জানান।