উত্তর ভারতের প্রাচীন রাজবংশ ও তাদের রাষ্ট্র সমূহ

উত্তর ভারতের প্রাচীন রাজবংশ ও তাদের রাষ্ট্র সমূহ

বৈদিক সাহিত্যে ও পৌরাণিক মহাকাব্যগুলিতে গঙ্গা-উপত্যকায় বহু প্রাচীন রাজবংশ ও রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ওই সমস্ত তথ্যের ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা বহু পরিমাণেই সন্দেহাতীত নয় এবং তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের সমর্থন মেলে না। মহাকাব্যগুলিতে যে-সমস্ত রাজবংশের নামের তালিকা পাওয়া যায়, দেখা যায় সেগুলি একেকটি গ্রন্থে একেক রকমের এবং সেগুলিতে ঘটনার যে-বিবরণ পাওয়া যায় তা-ও ভিন্ন-ভিন্ন ধরনের। ফলত, এইসব ব্যাপারে ভারততত্ত্ববিদের পক্ষে এই যুগের ইতিহাসের পুননির্দেশ কাজটি বহ পরিমাণে জটিল করে তুলেছে। বৈদিক ও পৌরাণিক পুস্তক গুলিতে তৎকাল- প্রচলিত ধর্মীয় ধ্যানধারণার প্রাচীন রাজাদের ও রাজবংশগুলির উৎপত্তির ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করেছে বিভিন্ন দেবদেবীর ইচ্ছাপ্রণোদিত বলে। এ-ব্যাপারে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে জানা যায় যে গঙ্গা-উপত্যকার প্রধান দুটি রাজবংশের নাম ছিল সূর্য ও চন্দ্রবংশ এবং এই দুই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন সূর্য ও চন্দ্রদেবতা থেকে উদ্ভূত। রামায়ণের প্রধান চরিত্র রামচন্দ্রকে দেখানো হয়েছে সূর্য- বংশোদ্ভূত বলে আর মহাভারতের কুরুবংশকে চন্দ্র-বংশোদ্ভূত হিসেবে। ঋগ্বেদে নাম উল্লিখিত আছে সেই রাজা ভরত ঐতিহ্য অনুসারে এই চন্দ্রবংশেরই প্রতিষ্ঠাতা।

ঋগ্বেদে তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু-কিছু তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু সেইসব তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কিছু পরিমাণে সন্দেহজনক। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, অথর্ববৈদে উল্লিখিত আছে দশজন রাজার মধ্যে যুদ্ধের ঘটনার কিংবা রাজা দাসের নেতৃত্বে রিংস, উপজাতি (ভরত বংশেরই একটি শাখা) এবং সম্ভবত স্থানীয় অনায় একটি উপজাতির (কারণ এই শেষোক্ত উপজাতির লোকজন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তারা দেবতার কাছে পুজা-বলিদান, ইত্যাদি দেবে না) মধ্যে সংগ্রামের কাহিনী। ওই মুখে বৈদিক আর্য ও স্থানীয় উপজাতিদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ যে অনবরত লেগে ছিল এই শেষোক্ত কাহিনী স্পষ্টতই তারই এক প্রমাণ। রে বগে ভরত বংশীয় রাজবংশ খুব সম্ভব সরস্বতী (সিনদের প্রাচীন একটি শাখা) ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী এলাকাটিতে রাজত্ব করতেন।

বৈদিক আর্য উপজাতির মধ্যে বাশীর উপজাতির প্রাধান্য ছিল বিশেষরকম। ঋগ্বেদে এই বংশের এক রাজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই কলে যে তিনি 'ম্লেচ্ছ' বা স্থানীয় অনার্য উপজাতিগুলিকে যুদ্ধে পরাস্ত করে বিজয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে এই পুরো কুর, (যা কৌরব) উপজাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযত হয়েছিল। বেদে অন্যান্য বহুতের উপজাতির কথাও উল্লিখিত আছে, যারা পরবর্তীকালে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সমস্ত উপজাতির মধ্যে পড়ে চেদী, গান্ধার ও কিরাত নামের (মাধ উপজাতির প্রাচীন নাম) উপজাতিগুলি।

এসবের মধ্যে রাজা ভরতের নামটি বিশেষ গৌরবে দীপ্যমান। এই नान রাজার সম্মানে এমন কি সেই সুন্দর প্রাচীনকালেও গোটা উত্তর ভারত অভিহিত হয়েছিল "ভারতবর্ষ" বা ভরতের উত্তরপুরুষের দেশ' নামে (বর্তমানে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রও সরকারিভাবে 'ভারত' নামে পরিচিত)। মহাভারতের কিছু কিছু বীর নায়কও ছিলেন ভরত-বংশীয়। এই মহাকাব্যে উল্লিখিত আছে যে ভরতের উত্তরপদের ওই মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

করে প্রান্তরে বা কুরুক্ষেত্রে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংগ্রাম এই যুগের পৌরাণিক মহাকাব্যগুলির একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই বৃদ্ধ কাহিনীর সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক বিবরণের খুটিনাটি কতখানি প্রমাণসাপেক্ষ তা ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে প্রচণ্ড বিতর্কে'র বিষয়। এই যুদ্ধের বিবরণকে বহু পণ্ডিত সত্য ঘটনা বলেই মনে করেন এবং বলেন যে এ ঘটনা ঘটেছিল স্টিপূর্ব চতুর্থ কিংবা তৃতীয় সহস্রাব্দের কোনো সময়ে সমকালীন ভারততত্ত্ববিদরা অবশ্য এই যুদ্ধের সময়টিকে ধনীস্টপূর্বে এগারো থেকে নয় শতকের মধ্যে নির্দিষ্ট করতেই বেশি আগ্রহী। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বক্সিরা (শ্রী বি. বি. লালের নেতৃত্বে) হস্তিনাপরে এই বিতর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদিও সংগ্রহ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মহাভারত কাবো হস্তিনাপ রকেই কৌরবদের রাজধানী বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

খননকার্যের ফলাফল দিয়ে বিচার করলে বলতে হয় যে অধিবাসীরা হস্তিনাপুর নগর বন্যার প্লাবনের জনো পরিত্যাগ করে যায় খ্রীস্টপূর্বে এগারো থেকে ন্যা শতকের মধ্যে। এইসব তথ্য কিন্তু মহাভারতে বর্ণিত তথ্যাদির সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। কুরুক্ষেত্রের বরাদ্ধ মসিতাই কোনোকালে ঘটেছিল নাকি তা কাল্পনিক একটি জনপ্রধাসমাত্র এ প্রশ্নের আলোচনা বাদ দিলেও, কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে ঘটনাটি সম্ভবত সদরে ইন্দো-ইরানীয় হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যখন উত্তর ভারতের উপজাতিগুলির মধ্যে দীর্ঘ এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে কিছু উপজাতি অন্যান্য উপজাতির ওপর নিঃসন্দেহে আধিপতাবিস্তারে সমর্থ হয়। এ-প্রসঙ্গে এটি লক্ষনীয় যে প্রাচীন ভারতীয় শাস্য সাহিত্যে সর্বত্রই রক্ষেত্রের যুদ্ধ নতুন একটি যুগের সূচক হিসেবে গ্রাহ্য। মহাকাব্যটির বিবরণ অনুযায়ী সে-যুগের সবচেয়ে পরাক্রান্ত ও প্রভাবশালী যে-পণ্যাল ও কুল উপজাতি দুটি, তারা অতঃপর তাদের রাজনৈতিক প্রভাব হারায় এবং রাজনৈতিক মঞ্চে দেখা দেয় পূর্বে ভারতের ছোট-ছোট রাষ্ট্র - বিশেষ করে কোশল (অযোধ্যা ও শ্রাবন্তীতে রাজধানী সহ), কাশী (বারাণসীতে রাজধানী) ও বিদেহ (মিথিলার রাজধানী) রাষ্ট্র। এছাড়া আধুনিক বিহারের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে দেখা দেয় মগধ (গিরিব্রজ ও পরে রাজগ, হতে রাজধানী সহ) এবং পশ্চিম ভারতে অবস্তা (উজ্জয়িনীতে রাজধানী) নামের রাষ্ট্রদটি।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে গোটা দেশে তিনটি বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা, আর্যাবর্ত (বা আর্যদের বাসভূমি) অর্থাৎ উত্তর ভারতরাজ্য, মধ্যদেশ অর্থাৎ মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্য এবং দক্ষিণাপথ অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতরাজা। গোটা দেশটি পাঁচ ভাগে, অর্থাৎ মধ্য, পূর্বে, পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর দেশে, বিভক্ত ছিল এমন উল্লেখও পাওয়া যায় কোথাও-কোথাও।

দেখা যাচ্ছে পরবর্তী বৈদিক যুগের সংহিতা ও উপনিষদগুলির রচয়িতারা গোটা উত্তর ভারত, মধ্য-ভারতের (অর্থাৎ নর্মদা নদীর উত্তর দিকস্থ বহু, অংশ এবং পূর্ব ভারতের সঙ্গে ভালোরকম পরিচিত ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে পরবর্তী মগধ-মৌর্য যুগের উৎপত্তির পটভূমি হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রখানি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন