ভারতের জাতিভেদ প্রথা ও উৎপত্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা | indian caste system in bengali

ভারতবর্ষের জাতিভেদ প্রথার উৎপত্তি


বর্ণ-বিভাগ ও জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্বকে সাধারণত কেবলমার ভারতের সমাজ- ব্যবস্থার সঙ্গেই যুক্ত করে দেখানো হয় বটে, তবে ঐতিহাসিক ও নকুল-বিদ্যাগত সাক্ষ্য-প্রমাণাদির সঙ্গে এই ধারণাটি কিন্তু পরোদার সঠিকভাবে খাপ খায় না। বর্ণ- বিভাগের কিছু কিছু দিক এবং জাতিভেদ প্রথার নানা উপাদান বহু জাতির সমাজ- ব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এটা ঠিক যে জাতিভেদ প্রথার বিকাশের সবচেয়ে লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত মেলে ভারতেই এবং ভারতীয় সমাজের সুনির্দিষ্ট পরিবেশেই এই প্রথাটি অত্যন্ত অনমনীয় একটা চেহারা পায়।

পোর্তুগিজ ভাষায় 'কান্তা' শব্দের অর্থ হল 'জাতি' অথবা 'বংশ' বা 'কুল'। গত ষোড়শ শতকে ভারতে অনুপ্রবেশ করে পোর্তুগিজরা ভারতীয় সমাজ-কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত হবার পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া এই 'কান্তা' শব্দের নানা রকমফের বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় চারিয়ে যায় (যেমন, ইংরেজিতে এটি হয়ে ওঠে 'কাস্ট) এবং এ দিয়ে ভারতীয় সমাজের মধ্যেকার কড়াকড়িভাবে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠ গুলিকে বোঝানো হতে থাকে। খোদ ভারতে এই জনগোষ্ঠীগুলি সংস্কৃত 'জাতি' শব্দটির দ্বারা চিহ্নিত।

ভারতে এই বর্ণ বা জাতিভেদের (অর্থাৎ, কড়াকড়িভাবে একই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক' সীমাবদ্ধ রাখা এবং সীমাবদ্ধ কয়েকটি ও বংশান কমিক বৃত্তি বা পেশার বৈশিষ্ট্যসূচক সুনির্দিষ্ট কয়েকটি সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে তারতম্যকরণের এই ব্যবস্থাটির উৎপত্তির প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতমহলের রচনায় তুমুল বিতর্কের ঝড় উঠতে দেখা গেছে। এই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করার সময় বহুবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত ব্যাপার এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বিকাশের সুনির্দিষ্ট ধারাটিকে বিবেচনার মধ্যে ধরা একান্ত অপরিহার্য।

বেশ কয়েকটি আলোচনা উপলক্ষে কার্ল মার্কস বলেছেন যে জাতিভেদ হল পূর্ববর্তী উপজাতীয় সমাজ-সংগঠনেরই একটি স্মারক চিহ্ন। জাতিভেদের মধ্যেই পূর্ববর্তী গোষ্ঠী বা উপজাতীয় সমাজ-বন্ধন চরম ও সবচেয়ে কঠোর 'চেহারা' নিয়েছে।

জাতির পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয় সমাজে আরও একটি সংপ্রাচীন বিধানের, অর্থাৎ সামাজিক গোষ্ঠী বা বা এর অতি ছিল। এই 'বা' এর উৎপত্তি ঘটেছিল প্রাক-শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, যা পরে শ্রেণী-সমাজে পড়লে ও পরিবীকৃত হয়ে ওঠে। ক্রমশ এই বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী বা 'বর্ণ (যথা, ान, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শস্ত্র) বেশি বেশি স্থিরনির্দিষ্ট ও অনমনীয় হয়ে ওঠে এবং 'জাতির রূপ নেয়। এ কারণেই ভারতীয় সমাজে 'বর্ণ'কে অনেক সময়ে 'জাতি' বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
'বর্ণ' এর উৎপত্তির প্রশ্নটি অত জটিল একটি ব্যাপার। তবে সামাজিক গোষ্ঠ বা 'বর্ণ'এর আবির্ভাবের সঙ্গে আদিম সমসমাজ-সম্পর্কের ভাঙন এবং সম্পত্তির মালিকানা ও সামাজিক পদমর্যাদার পার্থক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অসাম্যের বিকাশকে যুক্ত করে দেখাটা মুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়।

প্রাচীন ভারতে সামাজিক গোষ্ঠী গঠনের এই নির্দিষ্ট ধরনটির আবির্ভাবের ব্যাপারে এরকম ধারণা পোষণ করা বোধহয় অসমীচীন হবে না যে ইন্দো-আর্য' উপজাতিগুলি উত্তর ভারতে অনুপ্রবেশের সময় যাদের সম্মুখীন হয়েছিল সেই স্থানীয় উপজাতিগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বাহন তাদের সামাজিক সংগঠনসমূহের সানির্দিষ্ট প্রকৃতি খুব সম্ভব এ-ব্যাপারে বিশেষই এক ভূমিকা পালন করেছিল।

সমাজের উচ্চতর বর্গের যোদ্ধ, সম্প্রদায়কে নিয়ে গঠিত হয় ক্ষত্রিয় বর্ণ, পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায়কে নিয়ে ব্রাহ্মণ বর্ণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজগুলির কৃষক, কারিগর, ইত্যাদিকে নিয়ে বৈশ্য বর্ণ এবং পরিশেষে সামাজিক স্তরবিন্যাসের সর্বনিম্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত হয় শুদ্র বর্ণ। প্রাক-বৈদিক যুগেই এই বর্ণ-বিভাগের আবির্ভাব ঘটে। এখন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে প্রাচীন ইরানেও কিছু-কিছু, নিমাজিক গোষ্ঠী ছিল (ইরানীয় ভাষায় এই গোষ্ঠীগুলিকে বলা হোত 'পিতা', বৈদিক 'বর্ণ'এর মতো যার অর্থ হল রঙ) ফেগালির সঙ্গে উপরোক্ত প্রথম তিনটি ভারতীয় সামাজিক স্তরের মিল আছে। এজন্যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে সমাজকে তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করার এই পদ্ধতি পূর্ববর্তী ইন্দো-ইরানীয় যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল, এমন কি কিছু,-কিছু তথ্য এরকম ধারণা পোষণেরও অনুকূল যে সমাজ-বিন্যাসের এই পদ্ধতিটি সম্ভবত প্রচলিত ছিল এরও আগে থেকে।

ঋগ্বেদে উপরোক্ত প্রথম তিনটি (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) বর্ণের বহুবিধ উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে একমাত্র ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলেই বিবৃত হয়েছে এই উপাখ্যানটি যাতে বলা হয়েছে যে এই চতুর্বর্ণেরই উৎপত্তি হয়েছে পরের থেকে। এই পুরুষ সত্তেও লেখা আছে যে ব্রাহ্মণরা উৎপন্ন হয়েছিলেন 'পরুষ এর মখাহর থেকে, ক্ষত্রিয়রা বাহময় থেকে, বৈশারা উরুদ্বয় থেকে এবং শস্ত্রেরা পদদ্বয় থেকে।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেও এই বিষয়টি বারবার বিবৃত হয়েছে, তবে সেখানে বলা হয়েছে যে বর্ণসমূহের আবির্ভাব ঘটেছে দেবাদিদেব ব্রহ্মা থেকে। এই চতুর্বর্ণের আবির্ভাব ও তাদের পদমর্যাদাকে আশীর্বাদপতে করেন যাজক ব্রাহ্মণেরা। ानষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন ও তাঁদের সামাজিক পদে দেবভাব আরোপের জনো সর্বশক্তি নিয়োগ করেন ওই যাজক সম্প্রদায়। কাজেই প্রায় সকল বৈদিক সাহিত্যে অপর তিন বর্ণের নামোল্লেখের আগে গোড়াতেই যে ব্রাহ্মণের নাম উচ্চারিত হবে এর কারণ বোঝা মোটেই তেমন শক্ত নয়। শুধু তা-ই নয়, পূজা-অর্চনা, বাগযজ্ঞে পৌরোহিত্য ও ধর্মশাস্ত্র পাঠের ব্যাপারে তাঁদের বিশেষ অধিকারকে প্রবল উৎসাহে সমর্থন ও রক্ষা করে চলেছিলেন বাগণ-সম্প্রদায়। তবে বাস্তবক্ষেত্রে সত্যিকার ক্ষমতা ছিল তখন যোগ-সম্প্রদায় বা ক্ষতিরদের হাতে।

প্রথাগতভাবেই ক্ষত্রিয়-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা রাজপদে অধিষ্ঠিত হতেন। যেমন রাজাশাসন-ব্যবস্থার শীর্ষপদে থাকতেন তাঁরা, তেমনই রাষ্ট্রক্ষমতা প্ররোগের প্রধান হাতিয়ার সেনাবাহিনীকেও তাঁরা নিয়মাণ করতেন এবং প্রধান-প্রধান সামরিক পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেই আমরা ক্ষতির ও ব্রাহ্মণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের উল্লেখ দেখতে পাই, আর পৌরাণিক মহাকাব্যগুলিতে তো এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বের রীতিমতো বিস্তারিত কাহিনীই পাওয়া যায়।

পদমর্যাদায় পার্থক্য সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ এবং ক্ষরিয়রাই ছিলেন সমাজের সবচেয়ে সংবিধাভোগী ও ধনী সম্প্রদায়। শ্রমজীবী জনসাধারণ ও ক্রীতদাসদের ওপরে প্রভুত্ব করতেন তাঁরা।

জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ছিল অবশ্য বৈশ্য-সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন স্বয়ংশাসিত গ্রাম-সমাজের কৃষক, কারিগর, অপেক্ষাকৃত বড় খামারের মালিক এবং বণিকরা। রাজকরের বেশির ভাগ অংশই দিতেন বৈশ্যরা বৈদিক যুগে বৈশ্যরা তখনও পর্যন্ত কিছু পরিমাণে রাজনৈতিক অধিকারের অংশীদার ছিলেন এবং এমন কি রাষ্ট্রের কোনো-কোনো ব্যাপার নির্ধারণেও তাঁদের হাত থাকত।

এই তিনটি উচ্চতর বর্ণকেই তখন গণ্য করা হোত 'দ্বিজ' বলে এবং এই তিনটি বর্ণের মানুষের অধিকার ছিল উপনয়ন হওয়ার, অর্থাৎ বৈদিক আচারে দীক্ষিত হওয়ার শদ্রেরা কিন্তু 'দ্বিজ' ছিলেন না, কাজেই তাঁরা বঞ্চিত ছিলেন বৈদিক ক্রিয়া- কলাপে, যাগযজ্ঞে অংশ নেয়া থেকে কিংবা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার থেকে। শুভ্রেরা স্বভাবতই হতেন দরিদ্র, তাঁদের চেয়ে যাঁরা ধনী তাঁদের ওপর অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল। সবচেয়ে নিচু স্তরগুলির কারিগর এবং গৃহভৃতা পাওয়া যেত এই সম্প্রদায়ের মানুষের ভেতর থেকে। যদিও শূদ্ররা ঠিক ক্রীতদাস ছিলেন। না, তব, যে-কোনো মূহর্তে ক্রীতদাসের মতোই অন্যের অধীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল তাঁদের পক্ষে। উচ্চতর বর্ণগুলির প্রতিনিধিরা এই বর্ণ-বিভাগকে দুর্ভেদ্য বংশানুক্রমিক এক প্রথায় সংহত করে তোলার চেষ্টায় ছিলেন, শস্ত্রেদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করতে ও যাতে শূদ্রেরা 'দ্বিজ বর্ণ'গুলিতে অনুপ্রবেশ না করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতেও সচেষ্ট ছিলেন তাঁরা।

ঋগ্বেদের গোড়ার দিককার মণ্ডলগুলিতে শাস্ত্রদের কোনো উল্লেখ না থাকার কিছু কিছু, পণ্ডিত এই মত পোষণ করেছেন যে শূদ্রেরা আসলে ছিলেন আর্যদের হাতে পরাভূত ও বশীভূত স্থানীয় অধিবাসী। এই পণ্ডিতেরা বলেন যে এ-ধরনের বর্ণভেদের সাহায্যেই আর্যদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন, তাঁদের জাতিগত বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ এবং কৃষ্ণকায় স্থানীয় অধিবাসীদের দ্রবণের স্তনে অংপতিত করে রেখে তাঁদের দমন করার উপায় ঠাউরেছিলেন আমরা। এই তত্ত্বের পরিপোষকরা বিশেষ করে জোর দিয়েছেন "বা" কথাটির ওপর এবং বলেছেন যে 'বর্ণ' এর একটি অর্থ হল রঙ। কিন্তু এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে 'বর্ণ' শব্দটি বর্ণ-বিভাগের সময় মানুষের গায়ের চামড়ার রঙ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় নি। কেননা, প্রাচীন ইরানের মতো প্রাচীন ভারতেও উপাসনা-প্রণায় প্রতীকী বর্ণ স্মরণ করার একটি ঐতিহ্য চাদ ছিল, প্রতিটি "বা" বা গোষ্ঠীর সঙ্গে ছিল তখন নির্দিষ্ট একেকটি প্রতীকী রঙ।

বৈদিক যুগের শেষাংশে 'বর্ণগুলির মধ্যেই আবার পেশাভিত্তিক আরও ছোট- ছোট নানা ভেদ ও বিভাগ দেখা দিল। বৃহত্তর 'ফাগলি সহ এই বিভাগও পরে দেখা দিল অনড় ও অনমনীয় নানা 'জাতি' রূপে।

আপনার মতামত জানতে আমরা আগ্রহী । কমেন্টে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।  ও নিচে নিউসলেটার সাবস্ক্রাইব করে নিন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম