গণপরিষদ ও ভারতের সংবিধান রচনা (The Constituent Assembly and the Framing of the Indian Constitution)
ভারতে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংবিধান রচনার দাবি
গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে একটি সংবিধান রচনার কাজ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতের সংবিধান ভারতীয়দের দ্বারা রচিত হবে—এ ধরনের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বারা উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বস্তুত ভারতের স্বাধীনতার দাবির সঙ্গে সংবিধান রচনার দাবি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
১৯০৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যে 'স্বরাজ' সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে, সেই প্রস্তাবের মধ্যেই গণপরিষদ গঠনের দাবি নিহিত ছিল। এরপর ১৯২২ সালে গান্ধিজি তাঁর Young India পত্রিকায় গন পরিষদের অপরিহার্যতা ও অনিবার্যতার কথা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “স্বরাজ বা স্বাধীনতা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের থান হিসাবে আসবে না, ভারতের নিজস্ব সত্তার পূর্ণ বিকাশ ও ঘোষণা রূপেই স্বাধীনতার আবির্ভাব ঘটবে"।
ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদের পবি যখন ক্রমান্বয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে, তখন তা প্রতিরোধের জন্য ব্রিটিশ সরকার একটি কৌশল অবলম্বন করে। তারা ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে একটি 'শ্বেতপত্র' (White paper) প্রকাশ করল এবং কেন্দ্রে 'দ্বৈত শাসন (dyarchy) এবং প্রদেশগুলিতে দায়িত্বশীল শাসনব্যাবস্থা প্রবর্তনের কথা ঘোষণা করল। শ্বেতপত্রতে উল্লিখিত প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একটি বৈঠক আহবান করে। বৈঠকে শ্বেতপত্রটিকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং ঘোষণা করা হয় যে, সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান রচনার প্রস্তাবই কেবল শ্বেতপত্রের একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে ("The only satisfactory alternative to the white paper. is a constitution drawn up by a constituent assembly elected on the basis of adult Buffrage...")।
১৯৩৬ সালে ফৌজপুরে কংগ্রেসের যে সম্মেলন হয় সেখানেও গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করা হয়। বলা হয়, “কংগ্রেস ভারতে একটি সত্যকারের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাষ এবং এ ধরনের সরকার কেবল প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত গণপরিষদের মাধ্যমেই আসতে পারে" ("The Congress stands for a genuine democratic state in India and such a state can only come into existence through a constituent assembly elected on the basis of adult suffrage.")। ওই বছর জুলাই মাসে কংগ্রেস যে নির্বাচনি ইস্তাহার প্রকাশ করে তাতেও গণপরিষদ গঠনের দাবি সুঢ়ভাবে প্রকাশ করা হয়। ১৯০৮ সালে পণ্ডিত নেহেরু প্রায় একই সুরে বলেন, “কংগ্রেস চায় কোনো রকম বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচিত হবে।" ১৯৩১ সালের নভেম্বরে গৃহীত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে পুনরায় বলা হয়, কোনো স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার একমাত্র গণতান্ত্রিক পথ হল গণপরিষদ গঠন। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কোনো মানুষই এর বিরোধিতা করতে পারেন না। ১৯৪০ সালের রামগড় কংগ্রেসেও পূর্ণ স্বরাজ ও একটি পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়ে। একদিকে ভারতের স্বাধীন নেতৃবৃক্ষের চাপ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিকূল অবস্থা-এই দুয়ের প্রভাবে ১৯৪০ সালের ৮ই আগ ভাইসরয় তাঁর বিখ্যাত আগস্ট ঘোষণায় সর্বপ্রথম স্বীকার করেন যে, ভারতের সংবিধান রচনা ভারতীয়দের একান্ত নিজস্ব বিষয়।
অতঃপর ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ইংরেজ সরকার চার্চিলের মন্ত্রিসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিসকে (Station Crippa) ভারতে পাঠায়।
গণপরিষদ সম্পর্কে ক্রিস যে প্রস্তাবগুলি দেন সেগুলি হল:
(ক) যুদ্ধ শেষে সাধিধাম রচনার জন্য একটি নির্বাচিত সংস্থা গঠনের ব্যবস্থা করা হবে।
(খ) নতুন সংবিধান গ্রহণে অনিচ্ছুক কোনো প্রদেশ নিজের বর্তমান সাংবিধানিক অবস্থা বজার রাখতে পারবে।
(গ) ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে।
(ঘ) দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের জনসংখ্যার অনুপাতিক হারে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে।
(ঙ) ইংরেজ সরকার গণপরিষদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ সম্পাদন করা হবে। তবে মুসলিম লিগ ও কংগ্রেস কারও কাছেই ক্রিস প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়নি। মুসলিম লিগ পাকিস্তান ও পৃথক গণপরিষদ গঠনের দাবিতে অটল থাকে। কংগ্রেসও নানা কারণে ক্রিপস প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে।
ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে ইংরেজ সরকার পুনরায় ১৯৪১ সালে ক্যুপল্যান্ড (Coupland)-কে ভারতে পাঠায়। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে ঐকমত্যের নীতির ভিত্তিতে একটি ছোটো আকারের গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দেন। কপিল্যান্ড পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ভারতের গণপরিষদ গঠনের ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের তরফ থেকে সর্বশেষ কার্যকর পদক্ষেপ হল ক্যাবিনেট মিশন। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের পরাজয় ঘটে এবং শ্রমিক দল ক্ষমতাসীন হয়। ক্ষমতা অর্জনের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ভারতের স্বাধীনতা ও গণপরিষদের গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতে একটি বিশেষ প্রথি কমনসভার ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী এটলির ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ভারত সচিব পেথিক লরেন্স, নৌ-বাহিনীর প্রধান লর্ড আলেকজান্ডার ও বাণিজ্য বোর্ডের সভাপতি স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্সকে নিয়ে গঠিত ক্যাবিনেট মিশনকে ভারতে প্রেরণ করা হয়। মিশনের সদস্যরা কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কোনোরূপ ঐকমত্যে পৌঁছোতে ব্যর্থ হলে ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে ক্যাবিনেট মিশন নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
গণপরিষদ সম্পর্কিত মিশনের মূল প্রস্তাবগুলি হল নিম্নরূপ :
(১) ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে।
(২) গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৩৮৯। এর মধ্যে ২৯৬ জন আসবেন বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে। বাকি ৯৩ জন সদস্য মনোনয়নের ভিত্তিতে দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে প্ররিত হবেন।
(৩) প্রাদেশিক আইনসভাগুলি 'ক', 'খ', 'গ'- তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হবে এবং প্রত্যেক শ্রেণির আইনসভা তার সদস্যদের নির্বাচন করবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে। 'ক' শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলি (বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ) থেকে মোট ১৮৭ জন প্রতিনিধি গণপরিষদে আসবেন। এর মধ্যে ২০ জন হবেন মুসলমান। 'খ' শ্রেণির মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলি (পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু) থেকে ৩৫ জন আসবেন। এর মধ্যে ২২ জন হবেন মুসলমান, ৪ জন শিখ এবং বাকিরা অ-মুসলমান। 'গ' শ্রেণির অন্তর্গত (বাংলা, অসম) প্রদেশগুলি থেকে যে ৭০ জন প্রতিনিধি গ্রহণ করা হবে তার মধ্যে ৩৬ জন মুসলমান এবং ৩৪ জন হবেন অ-মুসলমান।
(৪) উল্লিখিত তিন শ্রেণির প্রদেশের সদস্যগণ পৃথকভাবে নিজ নিজ এলাকার জন্য সংবিধান রচনা করবেন।
(৫) অনুন্নত এলাকা বা অনুন্নত জাতিগুলির জন্য একটি উপদেষ্টা পর্ষদ (Advisory Board) গঠন করা হবে।
ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১২ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে এবং ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গণ পরিষদের সংবিধান রচনার কাজ শেষ হয়, কারন ওইদিন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রজাদের সম্মতি কমে ভারতের সংবিধানটি গৃহীত হয়।
ভারতের সংবিধান রচনা ও গণপরিষদের দাবি সম্পর্কে আশ্চর্যজনক মজাদার তথ্য সম্পর্কে আপনার অনুভূতি আমাদের কমেন্টে জানান?
আপনার ইনবক্সে প্রতিদিনের নতুন নতুন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য একেবারে বিনামূল্যে পেতে আমাদের বিনামূল্যের নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন ।
Tags
Political science