হরপ্পার সভ্যতা | উৎপত্তি , সীমানা ও ব্যাপ্তি ও সময়কাল (কাল নিরপেন)

হরপ্পার সভ্যতার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য 


একটা সময় ছিল যখন পণ্ডিতেরা সাধারণভাবে এই ধারণা পোষণ করতেন যে ভারতে সভ্যতার উদয় হয়েছিল অনেক পরে। বস্তুত, কিছু-কিছু, পণ্ডিত এমন মতও পোষণ করতেন যে ভারতে সভ্যতার আমদানি করেছিল বাইরে থেকে আসা আর্য উপজাতিগুলি। তখন প্রায়ই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাচীন প্রাচ্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির তুলনায় ভারতীয় সংস্কৃতির পশ্চাৎপদতার কথা বলা হোত।

তবে হরপ্পা-সভ্যতার আবিষ্কার ও তা নিয়ে গবেষণার ফলে এখন ভারতীয় সভ্যতার সংপ্রাচীনত্ব ও তার গভীর মৌল প্রকৃতি সম্বন্ধে লক্ষণীয় প্রমাণ মিলেছে। ১৮৭৫ ীস্টাব্দেই ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিৎ আলেকজান্ডার কানিংহাম হরপ্পায় (বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত পশ্চিম পঞ্জাবের মূলতান জেলায় অবস্থিত) অপরিচিত লিপি খোদাই করা একখানি পঞ্জা আবিষ্কার করেন, তবে সেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসম্মত খননকার্য শুর হয় মাত্র এ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে। সে-সময়ে দুই ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিৎ ডি. আর. সাহনি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় খননকার্য চালিয়ে হরপ্পা ও মোহেনজো-দারোয় (বর্তমান পাকিস্তানের সিদ্ধ প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত) দুটি প্রাচীন নগর আবিষ্কার করেন। অতঃপর নব-আবিষ্কৃত এই সভ্যতার নিদর্শন বিভিন্ন দেশের ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের বিপুল আগ্রহের সঞ্চার করে।

হরপ্পা-সভ্যতার উৎপত্তি-বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য 

হরপ্পা-সভ্যতার গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগগুলির মধ্যে সবচেয়ে জটিল একটি সমস্যা হল এ-সভ্যতার উৎপত্তির বিষয়টি। এ-সম্বন্ধে নানাবিধ মত প্রচারিত আছে। তার মধ্যে একটি হল হরপ্পা-সংস্কৃতির ভিত্তি হচ্ছে সমের-সংস্কৃতি। এছাড়া অপর একটি মত হল ইন্দো-আর্য উপজাতিগুলিই হরপ্পা-সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা, অর্থাৎ এই মত অনুযায়ী হরপ্পা-সভ্যতা আসলে বৈদিক সভ্যতাই। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিৎ আর হাইনে গেল্ডনার এমন কি এরকম মতও ব্যক্ত করেছেন যে সিদ্ধ-উপত্যকার এই সভ্যতা একদা আবির্ভূত হয়েছিল হঠাৎ, প্রায় শূন্য থেকে মাটিতে পড়েছিল যেন-বা, কেননা খননকার্য চালিয়ে গোড়ার দিকে এ-সভ্যতার পূর্ববর্তী বিকাশের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অবশ্য স্থানীয় ভিত্তিতে এই সংস্কৃতির উৎপত্তি সম্বন্ধে পূর্ণ নতুন-নতুন উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত মাটির নিচে বহতা জলের স্রোত থাকার প্রত্নতত্ত্ববিদনের পক্ষে আজও পর্যন্ত মোহেনজোদারোর সর্বনিম্ন স্তরটি অনুসন্ধান করে দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

বেলচিস্তানে ও সিন্ধু প্রদেশের নানাস্থানে খননকার্য চালাবার ফলে দেখা গেছে যে স্টিপূর্বে চতুর্থ ও তৃতীয় সহস্রাব্দে ওইসব অঞ্চলে এমন সব সংস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল যাদের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ, গোড়ার দিককার হরপ্পা-সভ্যতার সঙ্গে যাদের মিল ছিল অনেক দিক থেকে এবং যাদের সঙ্গে হরপ্পার বসতিগুলি দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছিল (ডা. এ. ফেয়ারসেভিস, বি. দ্য কার্দি, জে. এম. কাসাল, প্রভৃতির গবেষণালব্ধ ফল এই তথ্যগুলি)। সিদ্ধ, প্রদেশে কৃষির উদ্ভব ঘটছে এ-থেকে এই অনুমানের সপক্ষে সমর্থন পাওয়া যায় যে বেলচিস্তান ও দক্ষিণ আফগানিস্তান থেকে কিছু-কিছু উপজাতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল এই অঞ্চল পর্যন্ত।

এটা স্পষ্ট যে সিন্ধু নদের উপত্যকায় হরপ্পার বসতিগুলি হঠাৎ একদিন রাতারাতি আবির্ভূত হয় নি এবং সবকটি বসতি একসঙ্গেও আবির্ভূত হয় নি। স্পষ্টতই একটি বিশেষ কেন্দ্রে নগর-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল প্রথমে, তারপর সেখান থেকে লোকজন ক্রমশ বাইরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য বসতি গড়ে তোলে একে-একে । এ ব্যাপারে আমরি-বসতি নিয়ে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিৎ জে. এম. কাসালের গবেষণাটি বিশেষ আগ্রহোদ্দীপক। কাসাল আমরি-বসতির প্রাক-হরপ্পা যুগ থেকে হরপ্পার শেষ যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত স্তর-পরম্পরার একটি বিন্যাসের চিত্র গড়ে তুলেছেন। এই স্তরবিন্যাস থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির স্থানীয় বিকাশের ধারা অনুধাবন করা যায়। যখন প্রায় সব মৃৎপাত্র কুমোরের চাক ছাড়া হাতে গড়া হোত, ঘরবাড়ি তৈরি করা
ও ধাতুর ব্যবহার বিরল ছিল যখন, তখন থেকে শুরু করে অলঙ্কৃত মৃৎপাত্র ও না- পোড়ানো কাঁচা ইটে তৈরি অপেক্ষাকৃত পোক্ত বাড়িঘরের যুগলক্ষণ-চিহ্নিত অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরগুলি পর্যন্ত অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে এই স্তরবিন্যাসের ফলে। এখানকার প্রাক-হরপ্পা যুগের নিম্নতর গুরগুলির সঙ্গে বেল, চিস্তানের গোড়ার দিককার কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতিগুলির নানা ধরনের মিল লক্ষ্য করা গেছে, আর ওই প্রাক-হরপ্পা যুগের পরবর্তী স্তরগুলিতে যে-মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে, দেখা গেছে তা সিদ্ধ-উপত্যকার হরপ্পা বসতিগুলির গোড়ার আমলের সমকালে বানানো। পরিশেষে, এখানকার খননকার্যের ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে আরি-সংস্কৃতির বিশেষ লক্ষণাক্রান্ত ঐতিহ্যগুলি হরপ্পার ঐতিহ্যসমূহের সঙ্গে পাশাপাশি সহ-অবস্থান করেছিল।

হরপ্পার সংস্কৃতি ও তার পূর্ববর্তী আমরি সংস্কৃতি 

সংস্কৃতির মধ্যে পরস্পর- সংযোগের প্রশ্নটি প্রত্নতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে তাঁর বিতর্কের বিষয় হয়ে আছে। একদিকে এ. ঘোষের প্রবণতা হল ওই দুই সংস্কৃতির মধ্যে সহজাত একটা সম্পর্ক স্বীকার করে নেয়া, অন্যদিকে জে. এম. কাসাল মনে করেন যে হরপ্পার সংস্কৃতি আপনা থেকেই বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমরিতে মূর্ত হয়ে ওঠে নি, বরং তা ক্রমে- ক্রমে আমরির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল।

হরপ্পাতেই শহরের দূর্গ প্রাকারের নিচে পাওয়া গেছে আমরি-সংস্কৃতির নিদর্শনস্বরূপ মৃৎপাত্র আর মোহেনজোদারোর নিম্নতর গুরুগুলিতে পাওয়া গেছে বেল চিস্তানের সংস্কৃতির নিদর্শন মৃৎপাত্র। এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, কেবল-যে সিন্ধু-উপতাকার বসতিগুলি ও বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশের কৃষিজীবী সংস্কৃতিগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তা-ই নয়, হরপ্পার সভ্যতার নিজস্ব স্থানীয় ভিত্তিও ছিল। এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ওই অঞ্চলের এবং সবচেয়ে বেশি করে সিন্ধুনদের উপতাকার কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করেই, যদিও সেইসঙ্গে এ ছিল এক নতুন পর্যায়ের প্রতিনিধি, ব্রোঞ্জ যুগের এক অভিনব নগর-সভ্যতা ছিল এ ।

পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ববিদরা আধুনিক হাইপরে শহরের অদূরবর্তী কোট দিজিতে যে-খননকার্য চালান তা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে ওই অঞ্চলে প্রাক- হরপ্পা গে কিছুটা উন্নত ধরনেরই এক সংস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল। পণ্ডিতেরা এখানে মাটি পড়ে উদ্ধার করেন এক নগরদুর্গে ও বসতবাড়ির রীতিমতো কয়েকটি সারি। কোট দিজির প্রথম আমলের মৃৎপাত্রগুলির সঙ্গে সিদ্ধ, প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কৃষিভিত্তিক বসতিগুলির এবং সিন্ধু উপতাকার প্রাক- হরপ্পা যুগের মৃৎপাত্রের মিল পাওয়া যায়, আর কোট দিজির পরের আমলের মৃৎপাত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য মেলে খোদ হরপ্পার মৃৎপাত্রের। এর ফলে সেখানকার স্থানীয় ঐতিহ্যের ক্রমবিকাশের সূত্রটি খঙ্গে পাওয়া সম্ভব হয়। এদিকে হরপ্পার সভ্যতার অব্যবহিত পূর্বের একটি যুগের সন্ধান পান

ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা। রাজস্থানের কালিবাজায় একটি জায়গার খননকার্য চালিয়ে

তাঁরা দুটি ঢিপির ওপর হরপ্পার মানুষের পূর্ববর্তীদের দুটি বসতি আবিষ্কার করেন এবং পরে এখানে যে-সব ঘরবাড়ি আবিষ্কার করেন তাঁরা, 
দেখা যায়, সেগুলি স্পষ্টতই হরপ্পা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতাদেরই কীর্তি। এখানে প্রাক-হরপ্পা যুগের বসতিগুলি থেকে পাওয়া মৃৎপাত্রগুলি আম্‌র ও কোট দিজিতে পাওয়া মৃৎপাত্রের সঙ্গে বহ, দিক থেকে এক ধরনের। এই সমস্ত আবিষ্কারের ফলে পন্ডিতদের পক্ষে হরপ্পার সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের সূত্র এবং হরপ্পার গোড়ার দিককার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত পরিণত হরপ্পা-যুগের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সহ-অবস্থানের সূত্রটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা হরপ্পার ও গোড়ার দিককার হরপ্পা-সংস্কৃতির আরও অনেক নতুন-নতুন নিদর্শন স্মরণিক আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছেন। এর ফলে হরপ্পা-সভ্যতার উৎপত্তি সম্বন্ধে নতুন-নতুন তত্ত্বেরও উদ্ভব ঘটেছে। হরপ্পার সভ্যতা স্থানীয় প্রাক-হরপ্পা ও আদি হরপ্পা- সংস্কৃতিগুলি থেকেই ক্রমশ বিকশিত হয়ে উঠেছে – এই তত্ত্বটি ছাড়াও - এমন মতও চাল, হয়েছে যে আদি হরপ্পার অর্থাৎ গ্রামীণ ধরনের সংস্কৃতিগুলি এবং খোদ হরপ্পা অর্থাৎ নগর-সভ্যতা সম্ভবত পাশাপাশিই অস্তিত্ব বজায় রেখে এবং সমান্তরাল ধারায় বিকশিত হয়ে চলেছিল একদিন। বস্তুত, নগর-জীবনের উদ্ভব এবং বড়-বড় নগর-জনপদের আবির্ভাবই সেদিন ঘোষণা করেছিল এক নতুন কালপর্বের, সকল স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য (যেমন, লিপিখোদিত পঞ্জা, বর্ণলিপি ও লেখার

শিল্প, মৃৎপাত্রে মৌল ধরনের অলঙ্করণ, ইত্যাদি) সহ পরিণত হরপ্পা-সভ্যতার জন্ম। নগর-সভ্যতার দিকে পদক্ষেপের প্রবণতা অবশ্য আদি হরপ্পাযগে থেকেই আফগানিস্তান, বেল, চিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশের বহু নিদর্শন-ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, তত্ত্ব এ-ধরনের উন্নত নগর-সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল একমাত্র সিন্ধু নদের উপত্যকাতেই।

এই শেষোক্ত সভ্যতার বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল অবশ্যই অঞ্চলটির ভৌগোলিক পরিবেশ, অর্থাৎ সিন্ধুনদ ও তার শাখানদীগুলির জালবিস্তার। নদীমাতৃক এই অঞ্চলই বৈষয়িক সংস্কৃতি ও অর্থনীতিক বিকাশের এবং নগর-জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাদশিল্পের কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল পটভূমির যোগান দিয়েছিল। হরপ্পা-যুগের বসতিগুলি যে বিপুল সংখ্যায় সিন্ধুনদ ও তার শাখানদীগুলির তীর বরাবর গড়ে উঠেছিল এটা কোনো আপতিক ঘটনা নয়। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে গঙ্গা ও যমুনা নদীর ওপর- অঞ্চলেও নদীতীর বরাবর অনেকগুলি হরপ্পা-যুগের বসতি পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। হরপ্পা-সংস্কৃতির উৎপত্তি-সম্প ন্যাপারটি এখনও বহু পরিমাণে স্পষ্ট ও বিশদ করে তোলার অপেক্ষা রাখে, তবে এ-ব্যাপারেও সন্দেহ নেই যে ওই সভ্যতার উৎপত্তির সঙ্গে বহির্বিশ্বের, যেমন আর্য ও সূমের সভ্যতার প্রভাবের সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্বগুলি এখন নিছক পেশাদার ইতিহাসবেত্তাদের কৌতূহলের বিষয়ে পর্যবসিত হয়েছে।

হরপ্পা-সভ্যতার সীমানা ও ব্যাপ্তি

এই শতাব্দীর তৃতীয় দশকে হরপ্পার সভ্যতা নিয়ে অনুসন্ধানের কাজ প্রথম জ্বর, হল যখন, তখন মনে করা হচ্ছিল যে এ-সংস্কৃতির ভৌগোলিক বিস্তারের সীমানা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণই। বস্তুত, গোড়ার দিকে হরপ্পা-যাগের বসতিগুলি কেবলমাত্র সিন্ধু-উপতাকাতেই পাওয়া গিয়েছিল। তবে বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে জানা গেছে যে হরপ্পা-সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল বিশাল এক ভূখণ্ড জড়ে, উত্তর-দক্ষিণে যার বিস্তার ছিল ১,১০০ কিলোমিটারের বেশি ও পূর্ব-পশ্চিমে ১,০০০ কিলোমিটারের বেশি।

কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপে খননকার্য চালানোর ফলে জানা গেছে যে সিদ্ধ-উপত্যকা থেকে জনগোষ্ঠীর একেকটি দল ক্রমশ দক্ষিণে চলে গিয়ে নতুন-নতুন এলাকায় জনবসতি গড়ে তুলেছিল। বর্তমানে এই ধরনের হরপ্পা-যুগের সবচেয়ে দক্ষিণের যে-সমস্ত বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলি পাওয়া গেছে নর্মদানদীর মোহানার কাছে। তবে এ-ও সম্ভব যে হরপ্পার জনগোষ্ঠী এর চেয়ে আরও দক্ষিণাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। তারা দেশের পূর্বাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল, যাত্রাপথে নতুন- নতুন ভূখণ্ড 'অধিকার' করতে করতে। এর অর্থ, হরপ্পা-সংস্কৃতির কিছু-কিছু রকমফের গজিয়ে উঠেছিল এখানে-ওখানে, যদিও মোটের ওপর বলতে গেলে এগুলি সবই ছিল প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী একটিই অখণ্ড সংস্কৃতির নিদর্শন।

সৌরাষ্ট্রে ও কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপে সাম্প্রতিক খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হরম্পরযুগের বসতিগুলি পণ্ডিতদের দৃষ্টি ফের এই প্রশ্নটিতে নিবদ্ধ করেছে যে এত দূরে-দূর অঞ্চলে হরপ্পার জনগোষ্ঠীর এইভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী এবং তারা এত দূরে এসে পৌঁছলই-বা কী উপায়ে ?

কিছু-কিছু, পণ্ডিতের আগে ধারণা ছিল যে সিন্ধ-উপত্যকার সভ্যতার তথাকথিত শেষ পর্যায়ে যখন প্রধান নগর-কেন্দ্রগুলির হ্রাস পেতে শর করেছিল একমাত্র তখনই হরপ্পার জনগোষ্ঠী দেশের দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আবার অন্য অনেকে এই ধরনের ব্যাপকহারে ‘স্থানান্তরে গমন’এর কারণ হিসেবে অনুমান করতেন ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন অথবা বাইরে থেকে আগ্রাসনকে। কিন্তু পরবর্তীকালে গুজরাটে ও কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপে পূর্ণ-পরিণত হরপ্পা-সভ্যতার নগর-কেন্দ্রসমূহ (যেমন, গুজরাটে সারকোতাদ নামে নগর-বসতি) আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে পণ্ডিতেরা এখন মনে করছেন যে সিদ্ধ- উপতাকার নগরসমূহের অধিবাসীরা নিশ্চয়ই কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কারুশিল্পের অধিকতর বিকাশের জন্যে উপযুক্ত জমি জায়গা ও বন্দর, ইত্যাদির সন্ধানেই বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই হরপ্পা সভ্যতার 'সম্প্রসারণ এরই স্বাভাবিক একটি পদ্ধতি।

ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন যে হরপ্পার জনগোষ্ঠী সাধারণত স্থলপথে ও নদীপথেই ইতমত চলে গিয়েছিল (তারা সমুদ্রপথেও স্থানান্তরে গিয়েছিল বলে এস. আর. রাও যে তত্ত্বটি প্রচার করেছেন তা যথেষ্ট ব্যক্তিসহ নয়)। কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপে খননকার্যের ফলে জানা গেছে যে সেখানে হরপ্পার সংস্কৃতি ও তাম্র- প্রস্তরযুগীয় স্থানীয় সংস্কৃতি পরস্পরকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।

কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি যে এই বিপলোয়তন সভ্যতার মধ্যে যে-বহতের রকমফের লক্ষ্য করা যায় তা বেশকিছু, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর উপস্থিতির এবং হরপ্পা- সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতারা যে-সমস্ত বিভিন্ন অঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিল সেখানকার স্থানীয় বিকাশের অসমান স্তরেরই প্রতিফলনমা।

হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল

প্রত্নতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা এখন নানা ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে হরপ্পা- সভ্যতার কাল-নিরূপণে সমর্থ হয়েছেন। এ কাজ করেছেন তাঁরা সিন্ধু-উপতাকা ও মেসোপটেমিয়ায় প্রাপ্ত পুরা-নিদর্শনগুলির মধ্যে প্রতিতুলনার সাহায্যে (যেমন, সিদ্ধ -উপত্যকার হরফে খোদিত লিপি সহ পঞ্জা পাওয়া গেছে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যেকার কয়েকটি শহরে), মংপাত্রগুলির বর্ণালি -বিশ্লেষণ করে, সাম্প্রতিক কালে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ পদ্ধতির দ্বারা এবং প্রাচ্য পৃথিবীর সঙ্গে বাণিজ্য-সংক্রান্ত আকাডীয় আকর দলিলের উল্লেখের ওপর নির্ভর করে। গোড়ার দিকে পণ্ডিতেরা হরপ্পা-সংস্কৃতির অস্তিত্ব আরও অনেক বেশি দরেকালের বলে অনুমান করেছিলেন। তাঁদের এই অনুমানের ভিত্তি ছিল সামেরে ও ভারতে সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে বহুবিধ মিল লক্ষ্য করে তা থেকে টানা সাধারণ সিদ্ধান্তগুলি। অগ্রণী ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিৎ ও ভারতীয় প্রত্নবিদ্যা'র অন্যতম জনক সার জন মার্শাল খ্রীস্টপূর্ব ৩২৫০ সাল থেকে ২৭৫০ সাল সিন্ধু-সভ্যতার জীবনকাল বলে নির্দেশ করেন। কিন্তু পরে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার শহরগুলিতে খননকার্য চালাবার সময় সিন্ধু উপত্যকার ধাঁচের কিছু, পঞ্জা আবিষ্কৃত হওয়ায় এটা ধরা পড়ল যে এই পঞ্জাগুলির মধ্যে বেশির ভাগই সারগনের রাজত্বকাল (খ্রীস্টপূর্ব ২৩১৬ সাল থেকে ২২৬১ সাল), ইসিন যুগ (খ্রীস্টপূর্ব ২০১৭ সাল থেকে ১৭৯৪ সাল) এবং লাসা যুগ (স্টপূর্ব ২০২০ সাল থেকে ১৭৬৩ সাল)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। এই সমস্ত আবিষ্কারের ফলে পণ্ডিতেরা শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসেন যে মেসোপটেমিয়া ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্কের সময়কাল স্টিপূর্ব চব্বিশ থেকে আঠারো শতকের মধ্যেই নির্দিষ্ট করা যেতে পারে।

এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে আকাডীর যে-সমস্ত দলিলপত্রে প্রাচ্যদেশীয় অঞ্চলগুলির সঙ্গে, বিশেষ করে প্রত্নতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা যে-অঞ্চলগুলিকে সিদ্ধ- উপত্যকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা বলে সনাক্ত করেছেন সেই দিলমন ও মেহেতার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে'র সবচেয়ে বেশি উল্লেখ আছে, সেগুলি সবই উ এর তৃতীয় রাজবংশের (খ্রীস্টপূর্ব ২১১৮ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যেকার এবং লারসার রাজবংশের আমলের। লারসার রাজা গঙ্গন,মার রাজত্বকালের দশম বর্ষের (খ স্টিপূর্বে ১৯২০ সালের) তারিখচিহ্নিত কলিকাকার ফলকগুলির একটিতে সিদ্ধ-উপত্যকার ধাঁচের পঞ্জার একটি ছাপ পাওয়া গেলে পণ্ডিতসমাজে একদা গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয়। উপরোক্ত এই সমস্ত তথ্য এই ধারণার সপক্ষেই সাক্ষ্য দেয় যে সিদ্ধ-উপতাকার নগর-বসতিগুলির বাড়বাড়ন্ত ঘটে খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষদিকে ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সূচনায়। মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন শহরগুলির খননকার্য চালাবার সময় সেখানকার কাস্সীয় যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত স্তরগুলিতেও সিদ্ধ-উপত্যকার পঞ্জা পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয় ওই পর্যায়েও এই অঞ্চলের সঙ্গে সিন্ধু-সভ্যতার সংযোগ ছিল। হরপ্পার খননক্ষেত্রগুলির উচ্চতর স্তরসমূহে যে- ফাইআস (বা অলঙ্করণ করা পোড়ামাটির) টিকা পাওয়া গেছে, বর্ণালি-বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেছে যে সেগুলি ত্রুটি দ্বীপের নোসোস-এ (খ্রীস্টপূর্ব ষোল শতকের প্রাপ্ত গুটিকাগুলিরই সমতুল্য। এর ফলে হরপ্পার সভ্যতার শেষ কালপর্বটি খ্রীস্টপূর্ব ষোল শতকের বলে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।

অবশ্য তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে কালনির্ণয় করতে গিয়ে উপরোক্ত এই সন-তারিখের কিছুটা হেরফের ঘটাতে হয়েছে। বর্তমানে পণ্ডিতেরা কালিবাঙ্গায় অবস্থিত হরপ্পা-যুগের সংস্কৃতির প্রাথমিক স্তরগুলি ীস্টপূর্ব বাইশ শতকে উদ্ধৃত হয়েছিল বলে নির্ণয় করতে সমর্থ হয়েছেন এবং এখন বলা হচ্ছে যে হরপ্পা- সংস্কৃতির শেষ স্তরটি বর্তমান ছিল খীস্টপূর্ব আঠারো ও সতেরো শতক জুড়ে। মোহেনজোদারোর খননক্ষেত্রে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকেও একই ধরনের সন-তারিখের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে এই সভ্যতার পূর্ণ পরিণতির দিনগুলি কেটেছে স্টিপূর্বে বাইশ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে এবং মনে হচ্ছে সভ্যতাটি সম্ভবত টি ছিল খীস্টপূর্ব আঠারো শতক পর্যন্ত ( আনুমানিক ১১৫ বছর)। বেশিদিন আগেকার কথা নয় 'ডেনড্রোক্রোনলজি' (বা বৃক্ষবলয়ের সাহায্যে কালনির্ণয়বিদ্যা) নামে পরোকালের সন-তারিখ নির্ণয়ের নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পদ্ধতিপ্রয়োগে স্থিরীকৃত হরপ্পা-যুগের নগর-বসতিগুলির যে-বয়স জানা যাচ্ছে তা পণ্ডিতদের আবার সেই তত্ত্বের কাছাকাছি নিয়ে আসছে যে-তত্ত্ব অনুযায়ী সিন্ধ-উপত্যকার সভ্যতার বয়স সম্ভবত আরও কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দিতে হয়।

সিন্ধু-উপত্যকার সভ্যতার বয়স নির্ণয়ের চেষ্টা করার সময় এই কথাটি মনে রাখা বিশেষ দরকার যে ভারতের উপরোক্ত বিভিন্ন অঞ্চলে হরপ্পা-যুগের নগর ও বসতিগুলির অস্তিত্ব দীর্ঘ একটা সময় সীমা জুড়ে বর্তমান ছিল। যেমন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপে খননকার্যের ফলে দেখা গেছে যে এমন কি সিদ্ধ-উপত্যকার প্রধান নগর-কেন্দ্রগুলির অবলপ্তির পরেও হরপ্পা-যুগের সংস্কৃতির বাহন নগর-জনপদ তখনও সেখানে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে, তবে তা কিছুটা পরিবর্তিত চেহারায়। ভারতীয় পণ্ডিতদের পঞ্জাব ও হরিয়ানায় নতুন-নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে যা থেকে জানা যায় যে হরপ্পা-সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলের 'পূর্ব" প্রত্যন্তসীমায় পরেও বেশকিছু হরপ্পা- যুগের বসতির অস্তিত্ব ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার সম্পর্কে আশ্চর্যজনক বাংলা মজাদার তথ্য ও ফ্যাক্ট  সম্পর্কে আপনার অনুভূতি আমাদের কমেন্টে জানান? 

আপনার ইনবক্সে প্রতিদিনের আশ্চর্যজনক তথ্য মজাদার ফ্যাক্ট এবং অজানা বিভিন্ন লেখা বাংলাতে পেতে আমাদের বিনামূল্যের নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম